
পহেলগামের ঘটনার পর ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত শুরু হয়। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর রবিবার রাত ছিল পুরোপুরি শান্ত। রবিবার সীমান্ত ও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা শান্ত থাকলেও ভারত ও পাকিস্তান দুই পক্ষই এই সংঘাত নিয়ে পালটাপালটি দাবির কথা জানিয়েছে। গতকালই দুই দেশের মধ্যে সামরিক পর্যায়ে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের মধ্যে সরাসরি আলোচনা চায় বলে জানিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গতকাল জানিয়েছেন, দুই দেশের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধের হুমকি দেওয়ায় যুদ্ধ থেমে যায়।
ভারত যা বলেছে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর এক ব্রিফিংয়ে দাবি করেছে, দেশটির শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকার কারণে বেশ কিছু পাকিস্তানি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ ব্যর্থ করা হয়েছে। অপারেশন সিন্দুর নিয়ে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী গতকাল সোমবার এক প্রেস ব্রিফিং করে। সংবাদ সম্মেলনে বিমান বাহিনীর মহাপরিচালক এয়ার মার্শাল এ কে ভারতী দাবি করেন, ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী প্রাচীরের মতো। তিনি বলেন, ‘আমাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেশের জন্য প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল এবং শত্রুর পক্ষের জন্য এটি ভেদ করা অসম্ভব ছিল।’ এয়ার মার্শাল ভারতী দাবি করেন, ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাকিস্তানের ছোড়া ড্রোন এবং অন্যান্য অস্ত্র ভূপাতিত করেছে। এই সংবাদ সম্মেলনে দেশটির বিমান বাহিনী প্রধান কিছু ছবি দেখিয়ে দাবি করেন, হামলা করতে চীনের তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র পিএল-১৫ ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে তিনি এটিও বলেছেন যে, ভারতের ওপর ‘পিএল-১৫’ ক্ষেপণাস্ত্রটি হামলা চালাতে ব্যবহার করা হলেও তা লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে ব্যর্থ হয়েছে।
পাকিস্তান দাবি করেছে যে, তারা তিনটি রাফালসহ পাঁচটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছে। ভারতের বিমান বাহিনী প্রধান এ কে ভারতী অবশ্যই এই উত্তর দিয়েছেন অত্যন্ত কৌশলে। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের লড়াই ছিল সন্ত্রাসবাদ এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। যে কারণে ৭ মে থেকে আমরা কেবল সন্ত্রাসীদের আস্তানাগুলোতে আক্রমণ করেছি’। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সন্ত্রাসীদের সমর্থন করাকে উপযুক্ত মনে করেছে এবং এই লড়াইকে নিজের করে নিয়েছে। যে কারণে আমরা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি।’ তিনি একই সাথে পাকিস্তান থেকে ছোড়া তুর্কি ড্রোনগুলোও ভূপাতিত করার দাবি করেছেন।
ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পাকিস্তানের শেখ জায়েদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গত শনিবার ভোরে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রহিম ইয়ার খান জেলায় অবস্থিত বিমানবন্দরটিতে আকাশ থেকে ভূমিতে আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। বিমানবন্দরটি পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। হামলায় আমিরাতের প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবারের ব্যবহৃত রাজকীয় লাউঞ্জসহ বিমানবন্দরটির অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রহিম ইয়ার খান জেলার ডেপুটি কমিশনার খুররম জাভেদ। তিনি বলেন, শেখ জায়েদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর লক্ষ্য করে ভারত একটি ক্ষেপণাস্ত্র ও একটি ড্রোন দিয়ে হামলা চালিয়েছে। ভারতের বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের যে ৩২টি বিমানবন্দর গত কয়েক দিন বন্ধ রাখা হয়েছিল তা অবিলম্বে খুলে দেওয়া হচ্ছে।
পাকিস্তানের যে দাবি পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ দাবি করেছেন যে, তারা ভারতকে যুদ্ধবিরতির অনুরোধ জানাননি, বরং ভারতই যুদ্ধবিরতির বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। রবিবার রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে আইএসপিআর মুখপাত্র এই দাবি করেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়েছে যে, তারা যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি কঠোরভাবে মেনে চলছে। তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়ন্ত্রণ রেখায় যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি কঠোরভাবে মেনে চলছি। তবে যদি বিরোধী পক্ষ এটি (যুদ্ধবিরতি) লঙ্ঘন করে, তাহলে আমরাও যথাযথভাবে সেটার জবাব দেব।
একজন ভারতীয় পাইলট পাকিস্তানের হেফাজতে রয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে খবর ছড়িয়ে পড়েছে, সেটি সত্য নয় বলে নিশ্চিত করেছে আইএসপিআর। ব্রিফিংকালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা এয়ার ভাইস মার্শাল আওরঙ্গজেব আহমেদ দাবি করেছেন, সংঘর্ষ চলাকালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ভারতীয় বেশকিছু সামরিক স্থাপনা ও সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ধ্বংস করেছে। এছাড়া আকাশপথের যুদ্ধে ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে ছয়-শূন্য ব্যবধানে পাকিস্তান জয়লাভ করেছে বলেও দাবি করেন এয়ার ভাইস মার্শাল আওরঙ্গজেব আহমেদ। অন্যদিকে, ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষে পাকিস্তান তার সামরিক শক্তির সামান্য ঝলক দেখিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির আইএসপিআর মুখপাত্র। তিনি বলেন, ‘এটা মনে রাখা উচিত যে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর আধুনিক যুদ্ধক্ষমতা রয়েছে, যার মধ্যে সামান্যই (ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষে) ব্যবহার করা হয়েছে। বাকিটা ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে।’ তবে ভারত ও পাকিস্তানের পারমাণবিক যুদ্ধ জড়ানোটা নিছক বোকামি হবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
দুই দেশকেই চাপ দিয়েছিলাম: ট্রাম্প
গতকাল হোয়াইট হাউজে বক্তৃতার শুরুতেই ভারত ও পাকিস্তানের প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানান, মার্কিন প্রশাসন মধ্যস্থতা করে দুই দেশের মধ্যে তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি ঘটিয়েছে। এটি একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি হবে বলেও আশাবাদী তিনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটি ভয়ংকর সংঘর্ষ বন্ধ করা গেছে। দুই দেশেরই প্রচুর পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছিল, দুই দেশের কেউই থামতে চাইছে না।’ ট্রাম্প জানান, এই অবস্থায় মধ্যস্থতা করতে নেমে দুই দেশের সঙ্গেই বাণিজ্য বন্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছিল আমেরিকা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘তারা (ভারত এবং পাকিস্তান) যুদ্ধ বন্ধ করার নেপথ্যে একটি বড় কারণ হল ব্যবসা।’ তিনি জানান, ভারত এবং পাকিস্তান দুই দেশের নেতাই নিজেদের দিক থেকে অটল ছিলেন। দু’পক্ষের যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করতে আমেরিকা অনেক সাহায্য করেছে বলেও দাবি ট্রাম্পের। তিনি আরও জানান, ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশকেই বাণিজ্যের দিক থেকে সাহায্য করতে প্রস্তুত আমেরিকা। শিগগিরই পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনাও শুরু হবে বলেও জানিয়েছেন ট্রাম্প। -বিবিসি, ডন ও আনন্দবাজার পত্রিকা