
ভারত স্থলপথ ব্যবহার করে বাংলাদেশি পণ্য আমদানিতে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে সেসব পণ্যে, যা বাংলাদেশ বেশি রপ্তানি করে। ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শনিবার এ সিদ্ধান্তের কথা জানায়। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এখন ভারতের সিদ্ধান্তের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব বিশ্লেষণ করছেন। দেখে নেওয়া যাক, ভারত বাংলাদেশের জন্য কত বড় বাজার।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, ভারতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট ১৫৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ আসে ভারত থেকে। অন্যদিকে ভারত থেকে বাংলাদেশ ৯০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। এর বড় অংশ শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য। ভারতীয় ভোগ্যপণ্যের বড় বাজার বাংলাদেশ।
ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশটির শীর্ষ ১০ রপ্তানি গন্তব্যের ৮ নম্বর ছিল বাংলাদেশ। মোট রপ্তানি আয়ের ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ এসেছে বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশি পণ্যের শীর্ষ ১০টি রপ্তানি গন্তব্যের মধ্যে ভারত একটি। এর অবস্থান বছরভেদে আটের আশপাশে থাকে। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। এর পরে রয়েছে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন ও ফ্রান্স।
এশিয়ার দেশ জাপান অথবা চীন বাংলাদেশের রপ্তানি গন্তব্যের শীর্ষ তালিকায় নেই। রাশিয়াতেও রপ্তানি অনেক কম। চীনে বাংলাদেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ৭২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। ভারতে রপ্তানি করেছে এর দ্বিগুণের বেশি।
বাংলাদেশের রপ্তানি খাত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো নির্ভর। গুটিকয় বাজারের ওপর এই নির্ভরশীলতা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই অর্থনীতিবিদেরা বিভিন্ন সময় নতুন বাজার খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন। বিগত এক দশকে ভারত, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি বেড়েছে। অবশ্য কোনো কোনো বাজারে কোনো বছর কমেছে।
নতুন বাজার সৃষ্টি ও নতুন পণ্য রপ্তানি বাড়াতে সরকার নগদ সহায়তাও দিয়ে থাকে। পোশাকের বাইরে নতুন পণ্য হিসেবে ভালো করছিল প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য। বিশেষ করে ভারতের বাজারে বাংলাদেশের বিস্কুট, চানাচুর, চিপস, ফ্রুট ড্রিংক, পানীয়, শর্ষের তেল, কেক ইত্যাদি পণ্য বেশ ভালো রপ্তানি হচ্ছিল।
বাংলাদেশের কোনো কোনো ব্র্যান্ড ভারতের স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোকে প্রতিযোগিতা ও নতুন পণ্য বাজারে ছাড়ার ক্ষেত্রে পেছনে ফেলছিল। যেমন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ‘পটাটা’ বিস্কুট ভারতে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো তখন পটাটার মতো বিস্কুট তৈরি করা শুরু করে।
ভারতের বিধিনিষেধে কী আছে
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শনিবার যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তাতে কয়েকটি দিক রয়েছে— প্রথমত, ভারতের কোনো স্থলবন্দর ব্যবহার করেই দেশটিতে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানি করতে পারবে না। রপ্তানি করা যাবে কলকাতার হলদিয়া বন্দর ও মুম্বাইয়ের নব সেবা বন্দর দিয়ে। নব সেবা বন্দরটির নাম জওহরলাল নেহরু বন্দর।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ থেকে ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে শুল্ক স্টেশন ব্যবহার করে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পানীয়, আসবাব, প্লাস্টিক পণ্য, সুতা ও সুতার উপজাত ইত্যাদি রপ্তানি করা যাবে না। উল্লেখ্য, শুল্ক স্টেশন ও স্থলবন্দরের মধ্যে পার্থক্য হলো শুল্ক স্টেশনে স্থলবন্দরের মতো অবকাঠামো থাকে না। সেখানে শুধু শুল্ক সংগ্রহের ব্যবস্থা থাকে।
তৃতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্দা ও ফুলবাড়ী শুল্ক স্টেশন দিয়েও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পানীয়, আসবাব, প্লাস্টিক পণ্য, সুতা ও সুতার উপজাত ইত্যাদি রপ্তানি করা যাবে না। এর মানে, বাংলাদেশের লালমনিরহাটের বুড়িমারী ও পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা দিয়ে এসব পণ্য রপ্তানি হবে না। পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি, কোচবিহারসহ ওই এলাকায় বাংলাদেশের এসব পণ্যের বেশ চাহিদা আছে।
চতুর্থত, ভারত বাংলাদেশের মাছ, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি), ভোজ্যতেল ও ভাঙা পাথর আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করেনি। পাশাপাশি ভারতের বন্দর ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ প্রযোজ্য হবে না।
ভারতের বিধিনিষেধ শনিবার থেকেই কার্যকর হয়েছে। বাংলাদেশি পণ্য বন্দর থেকে ফেরত আসার ঘটনাও ঘটেছে। রোববার বাংলাদেশের প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ১৭ ট্রাক খাদ্য পণ্য বুড়িমারী দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি যাওয়ার কথা ছিল। ভারতের বিধিনিষেধের কারণে পণ্যগুলো আটকে যায়।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) সাবেক সদস্য ও বাণিজ্য বিশ্লেষক মোস্তফা আবিদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত ভারতের সাত রাজ্যে কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। ভারতের বিধিনিষেধের কারণে ওই সব রাজ্যে কার্যত বাংলাদেশের রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, বাংলাদেশের পক্ষে সমুদ্রবন্দর দিয়ে এবং পরে সড়কপথে ওই সব রাজ্যে রপ্তানি কঠিন।
ভারতের অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত। এসব রাজ্য ভূবেষ্টিত, কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে পণ্য পরিবহন জটিল ও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। তবে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে এসব রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থান। ফলে বাংলাদেশের জন্য ওই সব রাজ্যে পণ্য পাঠানো সহজ ও সাশ্রয়ী।
ভারত সাত রাজ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে নৌ-প্রটোকলের আওতায় বাংলাদেশের কাছ থেকে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা নেয়। কলকাতা বন্দর থেকে নৌপথে পণ্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে পাঠায়। সেখান থেকে সড়কপথে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরার আগরতলা যায়। নৌপথে কলকাতা থেকে আসামও যায় ভারতের পণ্য।
নতুন ব্যবস্থায় ভারতের সাত রাজ্যে বিধিনিষেধভুক্ত পণ্য স্থলপথে পাঠাতে হলে সাতক্ষীরার ভোমরা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দরই ভরসা। আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়ে পাঠাতে হলে প্রথমে পণ্যের চালান পশ্চিমবঙ্গে তথা কলকাতা যাবে। পরে কলকাতা থেকে সড়ক বা রেলপথে প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ওই পণ্য যেতে হবে ত্রিপুরার আগরতলায়। অবশ্য আসামের গুয়াহাটি, করিমগঞ্জ কিংবা মেঘালয়ের শিলংয়ে পণ্যের চালান পাঠাতে আরও কম পথ পাড়ি দিতে হবে।
সমুদ্রপথে পণ্য পাঠাতে হলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারতের মুম্বাই নব সেবা বন্দরে পাঠাতে হবে। আবার ঢাকা অদূরে পানগাঁও বা বাগেরহাটের মোংলা বন্দর থেকে কলকাতার হলদিয়া বন্দরে পাঠাতে হবে। এরপর সেখান থেকে সেভেন সিস্টার রাজ্যে নিয়ে যেতে হবে। তবে অনিয়মিতভাবে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে উপকূলীয় জাহাজ চলাচল ব্যবস্থার আওতায় কলকাতার হলদিয়া বন্দরে পণ্যের চালান যায়।
এ বিষয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, কলকাতা হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পণ্য পাঠাতে কমপক্ষে ১০ দিন সময় লাগবে। এতে আগরতলার আমদানিকারকেরা এত ঘোরা পথে পণ্য নেবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
ভারতে কোন পণ্য বেশি যায়
ভারতে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় পোশাক। ইপিবির তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশটিতে প্রায় ৫৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানি করে ওই অর্থবছরে ৩ হাজার ৮১৪ কোটি ডলার আয় করেছে। ভারতে গেছে মোট পোশাকের দেড় শতাংশের কিছু কম।
পোশাকের পরে বেশি যায় পাট ও পাটজাত পণ্য। দেশটিতে বাংলাদেশের পাট খাত ভালো করছিল। তবে ২০১৭ সালে দেশটি বাংলাদেশি পাটপণ্যে ‘অ্যান্টি ডাম্পিং’ শুল্ক আরোপ করে। উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে রপ্তানি করে স্থানীয় শিল্পের ক্ষতি করার অভিযোগে তারা এই শুল্ক আরোপ করে। ২০২৩ সালে শুল্কের মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়ানো হয়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও তেলজাতীয় পণ্য রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১২ কোটি ডলারের। এর পরে রয়েছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, আয়ের পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি ডলার।
ভারতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি করেছে সাড়ে চার কোটি ডলারের সমপরিমাণ।
দেখা যাচ্ছে, ভারতের বাজারে বাংলাদেশের প্রধান পাঁচটি পণ্যের তিনটি (পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও প্লাস্টিক) এবারের বিধিনিষেধে ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। একটি পণ্য (পাট) আগে থেকেই শুল্কবাধার মুখে পড়েছিল।
রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয় দুই ধরনের বাধায়। একটি শুল্ক আরোপ, অন্যটি অশুল্ক বাধা। পণ্যের মানসনদ–সংক্রান্ত জটিলতা, বন্দরে বারবার পরীক্ষা, নির্দিষ্ট বন্দর ব্যবহার করতে না দেওয়া ইত্যাদি অশুল্ক বাধার মধ্যে পড়ে।
সার্বিকভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, জানতে চাইলে মোস্তফা আবিদ খান বলেন, ভারতে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের মোট রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারতের বাজারের অংশ ৩ থেকে ৪ শতাংশ। সেটার ওপর প্রভাব পড়বে। এটা কতটুকু দুশ্চিন্তার, জানতে চাইলে তিনি বলেন, যিনি ব্যবসা করেন, তিনি টের পাবেন।
সামগ্রিকভাবে রপ্তানি আয়ের ওপর প্রভাব খুব একটা বড় না হলেও ভারতের বাজারনির্ভর ব্যবসায়ীদের জন্য বিধিনিষেধটি দুশ্চিন্তার। যেমন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ বছরে ৫ কোটি ডলারের পণ্য ভারতে রপ্তানি করে। তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার হাতিল ফার্নিচারের বেশ কিছু বিক্রয়কেন্দ্র ভারতে রয়েছে। তাদের পক্ষে সেগুলো টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
ভারতের সিদ্ধান্ত কি রাজনৈতিক
ভারতের এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক কি না, তা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য আসেনি। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে কারণ বলা হয়নি।
ভারতের গণমাধ্যমগুলো দেশটির সরকারের সিদ্ধান্তকে পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবেই দেখাচ্ছে। এনডিটিভির শনিবারের প্রতিবেদনে সরকারের এক কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে বলা হয়, বাংলাদেশ ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। সেটার পাল্টা হিসেবেই নতুন বিধিনিষেধ আরোপ।
ভারত গত এপ্রিলে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানিতে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করে। এরপর গত ১৫ এপ্রিল বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) স্থলপথে ভারত থেকে সুতা আমদানি নিষিদ্ধ করেছিল।
পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি, এটি দুই দেশের পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের অংশ।’